‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’

সুজন কান্তি পাল

মৃদুল কান্তি পাল আমার পিতা। কিন্তু অন্য সবাই যেমন পিতাকে পিতা হিসেবে মূল্যায়ন করে অামি ওনাকে সেভাবে তেমন দেখিনা।অন্য দশ জনের মতো শিক্ষক হিসেবেই মূল্যায়ন করি বেশি। তিনি আমার দেখা একজন আদর্শ শিক্ষক। আমি ওনার ছাত্র। মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক যখন তিনি ছিলেন তখন তিনি হরদম ক্লাস নিতেন। কিন্তু মাঝে বাধ সাজেন মরহুম আবদুল হাই। হলদিয়ার একজন বরেণ্য ব্যক্তি। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তৎকালীন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য।

আমার পিতা জীবিকা নির্বাহের জন্য কিন্তু শিক্ষককতার পাশা-পাশি প্রথম জীবন থেকেই পল্লী চিকিৎসায় মনোনিবেশ করে ছিলেন। মরিচ্যা বাজারে ওনার একটা তখন ছোট্ট চেম্বারও ছিলো। লোকমুখে শুনা যায় চিকিৎসা পেশায় ওনার নাকি বেশ হাত-যশ।

ঐ সুবাধে একদিন আমার শ্রদ্ধেয় আংকেল আবদুল হাই আমার বাবার চেম্বারে আসলেন। ওনি কিন্তু আমার বাবার ভাই / বন্ধুর মত ছিলেন। ছোটবেলায় দেখেছি প্রায় আড্ডা দিতে আমার বাবার চেম্বারে আসতেন। অার অামার মায়ের হাতে(বাড়ী থেকে পাঠানো) বানানো চা পান করতেন। ঐদিনটি ছিলো একটু ব্যতিক্রম- শ্রদ্ধেয় আংকেল হঠাৎ প্রস্তাব দিলেন ” মৃদুল বাবু তোমাকে মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে হবে। সেখানে আর কোন মেধাবী আর সৎ মানুষ নেই”। আমার বাবা প্রতি উত্তরে বললেন – ”আমি সহকারী প্রধানের দায়িত্ব নিলেতো চেম্বার করতে পারবোনা। প্রশাসনিক দায়িত্ব বেড়ে যাবে। আমি বিদ্যালয়ের সামান্য বেতন দিয়ে সংসার চালাবো কি করে”। তার জবাবে শ্রদ্ধেয় আবদুল হাই আংকেল বললেন ” না তোমাকে দায়িত্ব নিতে হবে। চেম্বার করার জন্য আমরা কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা সময় বের করে দিবো”

অবশেষে ওনার পিড়াপীড়িতে আমার বাবা রাজী হয়ে গেলেন। তখন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহামুদুল হক চৌধুরী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে পদাধিকার বলে বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। তখন নিয়ম মাপিক আবেদন করে আমার বাবা মৃদুল কান্তি পাল পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে মরিচ্যা পালং উচ্চ বিদ্যালয়ে১০-০৮-৮৮ তারিখে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। প্রায় ১৫ বছরের অধিক দায়িত্ব পালনের পর ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তৎকালীন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহীম আজাদকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করলে আমার পিতা সহকারী প্রধান হিসেবে নিয়ম অনুযায়ী ২৯-০১-২০০৪ তারিখ থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শুরু করেন।

তৎসময়ে ইব্রাহিম আজাদ তাঁর বহিষ্কার অাদেশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। এক পর্যায়ে আদালত ইব্রাহিম আজাদের বহিষ্কারকে অবৈধ ঘোষণা করলে তিনি আবার ৩০-০৭-২০০৫ তারিখ স্বপদে যোগদান করেন। এবং অামার পিতা তাঁর স্বপদ সহকারী প্রধানের দায়িত্বে চলে যান। পরবর্তীতে ইব্রাহীম আজাদ অবসরে চলে গেলে আবারো ২১-০৪-২০০৭ থেকে আমার পিতাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব নিতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি তখন আমার পিতাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব নিতে অপারাগতা প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু আইন অনুযায়ী বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক না থাকলে সহকারী প্রধানকে বাধ্যগত দায়িত্ব নিতে হয় বলে সেদিন তিনি আবারো ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন। এর পর তাঁর অধীনে বিদ্যালয়টি বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু বিধি বাম। ২০০৮ মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হলে মো: ইসলামের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি একটি বৈঠকে সম্পূর্ণ কোরামবিহীন অবস্থায় ০৫-০৮-২০১০(অধিকাংশ সদস্য সভা বর্জন করেছিলো) আমার পিতাকে প্রথমে বাধ্যতামূলক ছুটি ও পরে কোন প্রকার যোগদানের সুযোগ না দিয়ে ২৫-০৯-২০১০ তারিখ সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছৈয়দুল আলম চৌধুরীকে প্রধান শিক্ষক (চলতি) দায়িত্ব প্রধান করেন। অন্যদিকে আমার পিতা তাদের সাময়িক বহিষ্কার আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ও শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত দীর্ঘ শুনানীর পর আমার পিতা মৃদুল কান্তি পালের বহিষ্কারকে অবৈধ ঘোষণা করেন। কিন্তু বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি সম্পূর্ণ গায়ের জোরে আমার পিতাকে আর বিদ্যালয়ে যোগদান করতে দেননি।এই কারণে আমার পিতা আবারো বিজ্ঞ অাদালতের আশ্রয় নেন। আদালত রায় দেওয়ার পূর্বেই আমার পিতার চাকরির বয়সসীমা পার হয়ে যায়।যার কারণে আদালত আমার পিতার জবানবন্দী নিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকে তাঁর পেনশন, বেতন থেকে শুরু করে যাবতীয় সুবিধাদি প্রদান করার নির্দেশনা দিয়ে মামলাটির নিষ্পত্তি করে দেন।

কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস ২০১০ সালে মরিচ্যার নব্য কাশিম বাজারের কুটির থেকে শুরু হওয়া সেই ষড়যন্ত্রের এখনো শেষ হয়নি। আদালতের রায়ের পর আরো ৩ টি কমিটি বিদায় নিয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু আমার পিতার ভাগ্যের চাকা আর সচল হয়নি। বর্তমান কমিটিও প্রায় ১ বছরাধিকাল পূরণ করে ফেলেছে। কিন্তু মৃদুল কান্তি পালের ভাগ্যের চাকা যেখানে থেমে গিয়েছিলো সেখান থেকে যেনো অার চলছেনা। এখনো মৃদুল কান্তি পাল তাঁর পেনশন ও বেতনের ফাইলে স্বাক্ষরের জন্য তাঁর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় কার্যালয়ে ধর্ণা দেন। কিন্তু বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম তাঁর হাতে গড়া ছাত্র হওয়া সত্বেও তাকে নূন্যতম সম্মানটুকুও প্রদর্শন করেন না।তাই আর তিনি সেদিকে যেতে চান না। নিজেকে অচল পয়সা মনে করে হতাশ হয়ে যান। এবং নিজেই আক্ষেপ করে বলেন সৎ থাকলে এই সমাজে অচল পয়সা হয়ে থাকতে হবে!

ইতিমধ্যে বিদ্যালয়টির বয়স দেখতে না দেখতেই ৫০ বছর পূরন করেছে। তাই তার জয়ন্তী উৎসব পালনের ডাক পড়েছে। সবাই হুমড়ী খেয়ে পড়েছে তা পালনের জন্য। জয়ন্তী পালনে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়।

কারণ আমিও এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। তবে আমার আর্জি ও পরিষ্কার চাওয়া ”জীবনের তরে স্মৃতির বাতিঘরে” স্লোগান দিয়ে আপনারা যারা আজ সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা একবার বুকে হাত দিয়ে বলবেন কী বাতিঘরের ভিতর আর কোন অন্ধকার আপনারা থাকতে দিবেন না!

বাতির আলো জ্বালানো কোন মানুষের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদতে দিবেন না? অপেক্ষায় থাকলাম। মনে রাখবেন যদি আপনারা তা করতে না পারেন ইতিহাসের কাঠগড়ায় একদিন আপনাদেরও দাঁড়াতে হবে। অতএব সাধু সাবধান।

লেখক: সাংবাদিক।